Monday, 23 May 2022

দলিল রেজিস্ট্রি পদ্ধতি এবং রেজিস্ট্রির ধাপসমূহ


প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহঃ দলিল রেজিস্ট্রির জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ক্রেতাকে সংগ্রহ করতে হবে। বিক্রেতার নিকট থেকে জমির মালিকানা সম্পর্কিত কাগজপত্র যেমন- প্রয়োজনীয় বায়া দলিল, খতিয়ান (সি,এস,; এস,এ,; আর,এস, বা বি,এস,; নামজারি বা খারিজ ইত্যাদি; আপনার জন্য যেটি প্রযোজ্য), ভূমি উন্নয়ন কর (পূর্বে খাজনা নামে পরিচিত ছিল) পরিশোধের রশিদ, মৌজা ম্যাপ, টিআইএন সার্টিফিকেট, জাতীয় পরিচয়পত্র/পাসপোর্ট/জন্মসনদপত্র ইত্যাদি সংগ্রহ করে তা যাচাই-বাছাই করতে হবে। আপনার জমি-জমার কাগজপত্র সম্পর্কিত ভাল ধারণা না থাকলে প্রয়োজনে একজন সনদপ্রাপ্ত দলিল লেখক বা আইনজীবীর পরামর্শ নিতে পারেন।

দলিল প্রস্তুতকরণঃ- বিক্রেতার নিকট থেকে সংগৃহীত কাগজ-পত্র সঠিক পাওয়া গেলে খতিয়ান ও ম্যাপ অনুসারে জমির অবস্থান ঠিক আছে কিনা তা একজন আমিন দ্বারা মেপে দেখতে হবে। এরপর একজন দলিল লেখক বা আইনজীবীর মাধ্যমে দলিলের সরকার নির্ধারিত ফরমেট অনুসরণ করে দলিল প্রস্তুত করতে হবে।b এজন্য জমি-জমার আইন কানুন এবং দলিল রেজিস্ট্রি সম্বন্ধে ভাল ধারণা আছে এমন একজন সরকারি সনদপ্রাপ্ত দলিল লেখক বা আইনজীবী বাছাই করতে হবে। প্রয়োজনে দলিল লেখক বা আইনজীবী  সম্বন্ধে অধিকতর খোজ-খবর ও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। দলিলের পাশাপাশি সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিসে পাঠানোর জন্য প্রযোজ্য ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ফরমেটে এল,টি নোটিশ (সম্পত্তি হস্তান্তর নোটিশ) লিখতে হবে।

প্রস্তুতকৃত দলিলটি যাচাইকরণঃ- প্রস্তুত হয়ে গেলে দলিলটি ভালভাবে পড়ে দেখতে হবে যে, আপনার উদ্দেশ্য অনুযায়ী দলিলটি সঠিকভাবে প্রস্তুত হয়েছে কিনা, বিশেষ করে দলিলের ‘তফশিল’ অংশে মৌজার নাম, জমির খতিয়ান নম্বর, দাগ নম্বর, জমির পরিমান সঠিকভাবে লেখা হয়েছে কিনা এবং ‘হাত নকশা’ অংশে সঠিকভাবে জমির ম্যাপ অনুসারে হাত অংকন করা হয়েছে কিনা। দাগ নম্বর, খতিয়ান নম্বর এবং জমির পরিমাণ অংকে লেখার পাশাপাশি কথায় লেখা নিশ্চিত করতে হবে।

দলিল সম্পাদনঃ- ‘দলিল সম্পাদন’ অর্থ দলিলের দাতা/বিক্রেতা বা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অন্যান্য দলিলের পক্ষগণ কর্তৃক দলিলের প্রতি পৃষ্ঠায় আড়াআড়িভাবে নাম-স্বাক্ষর করা। দলিল সম্পাদনের মাধ্যমে দলিলে লিখিত বিষয়বস্তু অনুমোদন করা হয়ে থাকে। নাম-স্বাক্ষর অর্থ আপনার পূর্ণ নাম (সংক্ষিপ্ত স্বাক্ষর নয়) দলিলের প্রতি পৃষ্ঠায় লেখা।

এছাড়া সম্পত্তি হস্তান্তর দলিলের ১৭নং কলামে নাম স্বাক্ষর এবং ৩নং কলামের ক্রেতা/গ্রহিতার ছবি ও স্ট্যাম্পে বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলির টিপ এবং নাম-স্বাক্ষর করতে হয় (এমনভাবে টিপ ও নাম-স্বাক্ষর করতে হয় যাতে টিপ ও নাম অর্ধেক ছবিতে ও অর্ধেক স্ট্যাম্পে পড়ে)।

যে তারিখে দলিলটি সম্পাদন করা হয়, সেই তারিখকে সম্পাদনের তারিখ বলে। 

সাফ-কবলা, দানপত্র, দানের ঘোষনাপত্র, হেবার ঘোষণাপত্র, হেবাবিল এওয়াজ দলিলের ১০ (দশ) নম্বর কলামে সম্পাদনের তারিখ বাংলায় এবং ইংরেজিতে দিতে হয়। পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দলিলের ১ (এক) নম্বর কলামে সম্পাদনের তারিখ দিতে হয়। অন্যান্য দলিল যেগুলোর সরকার নির্ধারিত কোন ফরমেট নেই, সেগুলোতে সুবিধামত যে কোন যায়গায় সম্পাদনের তারিখ দেয়া যায়।

সাধারণত কোন ব্যক্তি লিখতে পারলে তিনি নিজে দলিলের প্রতি পাতার নির্দিষ্ট স্থানে তার নাম লিখেন এবং লিখতে অসমর্থ হলে তার পক্ষে ঐ দলিলের সনাক্তকারী সম্পাদনকারীর নাম ব-কলমে দলিলের নির্দিষ্ট যায়গায় লিখে দেন এবং নিজের নামও স্বাক্ষর করেন।

সাফ কবলা, হেবার ঘোষনাপত্র, দানের ঘোষনাপত্র, দানপত্র, হেবাবিল এওয়াজ প্রভৃতি দলিল দাতা সম্পাদন করেন। কিন্তু বায়নাপত্র উভয় পক্ষকে সম্পাদন করতে হয় (রেজিস্ট্রেশন আইন, ১৯০৮ এর ১৭(এ) ধারা অনুসারে)। বন্টননামা, বিনিময় প্রভৃতি দলিলে সকল পক্ষকে সম্পাদন করতে হয়।

রেজিস্ট্রি অফিসে রেজিস্ট্রির জন্য দলিল দাখিল করাঃ– দলিল সম্পাদনের পর মূল দলিল; এল,টি নোটিশ (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের একসেট ফটোকপি এবং বিভিন্ন খাতে রেজিস্ট্রেশন ফি, কর ও শুল্ক পরিশোধের মূল পে-অর্ডার (একসেট ফটোকপিসহ) সাব-রেজিস্ট্রারের নিকট দাখিল করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় মূল কাগজপত্র সাব-রেজিস্ট্রারের নিকট প্রদর্শনের জন্য প্রস্তুত রাখতে হবে।

সাব-রেজিস্ট্রার কর্তৃক দলিল পরীক্ষা এবং সম্পাদনকারী (দাতা/বিক্রেতা বা অন্য পক্ষ) কর্তৃক সম্পাদন স্বীকার করার পর রেজিস্ট্রি অফিসে রক্ষিত ‘টিপের বহি’তে সম্পাদনকারীর বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলির টিপ গ্রহণ করা হয়। এভাবে রেজিস্ট্রির জন্য দলিল গ্রহণ করার পর দলিলের দাখিলকারী বা দাখিলকারী কর্তৃক মনোনীত অন্য কোন ব্যক্তিকে ‘৫২ ধারার রশিদ’ প্রদান করা হয়। এই রশিদ সযত্নে সংরক্ষণ করতে হবে কেননা রেজিস্ট্রির পর মূল দলিল ফেরত নেওয়ার সময় এই রশিদ রেজিস্ট্রি অফিসে জমা দিতে হয়।

দলিল রেজিস্ট্রিঃ- রেজিস্ট্রি অফিসে ‘রেজিস্ট্রির জন্য দলিল গ্রহণ’ ও ‘দলিল রেজিস্ট্রি’ একই বিষয় নয়। রেজিস্ট্রির জন্য রেজিস্ট্রি অফিসে যে দলিলটি গৃহিত হলো তা রেজিস্ট্রি করতে অফিসভেদে দুই-তিন বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। রেজিস্ট্রির জন্য গৃহিত দলিলে প্রথমে দলিল দাখিলকারী, সম্পাদনকারী, সনাক্তকারী, দলিল দাখিলের সময়-তারিখ, পরিশোধকৃত ফি, কর ও শুল্ক ইত্যাদি বিষয়ে পৃষ্টাঙ্কন ও সাব-রেজিস্ট্রার কর্তৃক স্বাক্ষরের পর দলিলটি বালাম (ভলিউম) বহিতে ধারাবাহিকভাবে নকল করা হয়।

এরপর মূল দলিলের শেষ পৃষ্টার উলটো পার্শ্বে ‘দলিলটি কত সালের, কত নম্বর বালাম বহির, কত পৃষ্টা থেকে কত পৃষ্টায় নকল করা হয়েছে’ তা লিখে সাব-রেজিস্ট্রার কর্তৃক স্বাক্ষর করা হয়। দলিলটি বালাম বহিতে নকলকরা এবং সাব-রেজিস্ট্রার কর্তৃক স্বাক্ষর করার নাম দলিল রেজিস্ট্রি। দলিলটির রেজিস্ট্রি কার্যক্রম শেষ হলে দলিলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ (দাতা/বিক্রেতা-গ্রহিতার নাম, মৌজার নাম, দাগ নম্বর ইত্যাদি) নিয়ে ‘সূচিবহি’ তৈরি করা হয়, যাতে দলিলটি ভবিষ্যতে সহজেই খুজে পাওয়া যায়।

মূল দলিল ফেরত প্রদানঃ- দলিলের রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া শেষ হলে রেজিস্ট্রির জন্য দলিল দাখিলের সময় প্রদানকৃত ‘৫২ ধারার রশিদ’ জমা দিয়ে দাখিলকারী বা তার মনোনীত ব্যক্তি মূল দলিল গ্রহণ করতে পারেন। দলিল ফেরত গ্রহনের নোটিশ প্রদানের তারিখ হতে এক মাসের মধ্যে মুল দলিল ফেরত না নিলে পরবর্তী প্রতি মাস বা তার অংশ বিশেষের জন্য ৫/- টাকা হারে জরিমানা আদায় করা হয়। তবে বিলম্ব যত মাসই হোক না কেন, জরিমানা ১০০/- টাকা এর বেশী আদায়ের বিধান নাই।

রেজিস্ট্রি শেষ হওয়ার পর কোন দলিল দাবীবিহীন অবস্থায় ২ (দুই) বছরের বেশি রেজিস্ট্রি অফিসে পরে থাকলে “রেজিস্ট্রেশন আইন, ১৯০৮” এর ৮৫ ধারার বিধান মতে, রেজিস্ট্রেশন অধিদপ্তরের পূর্ব অনুমোদনক্রমে সেগুলো ধ্বংস করে ফেলা যায়। সুতরাং সময়মত মূল দলিল সংগ্রহ করে সংরক্ষণ প্রয়োজন।

এখানে দলিল প্রস্তুত থেকে শুরু করে মূল দলিল ফেরত প্রদান পর্যন্ত দলিল রেজিস্ট্রি প্রক্রিয়ার ধাপসমূহ চার্ট আকারে প্রকাশ করা হলঃ

শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.

0 coment rios: